প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে সকালে ভ্যান রিজার্ভ করে বেলা গড়িয়ে ক্লান্ত শরীরে ভাতার টাকা নিয়ে বাড়ীতে পৌঁছানোর দিন শেষ হয়েছে এবার। এখন সমাজসেবা অধিদপ্তরের সুবিধাভোগীরা ঘরে বসেই মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে তাদের ভাতার অর্থ পাচ্ছেন। এরই মধ্যে প্রায় ৯০ লাখ সুবিধাভোগী মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে ঘরে বসে তাদের ভাতা পেয়েছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিলো ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশের। তার এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য গ্রামীণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্ঠনীর আওতায় সমাজসেবা অধিদপ্তর হতে চালু করা হয়েছে বয়স্ক, বিধবা, অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা সহ নানা ধরনের সেবা, যা দরিদ্র মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে কার্যকরী। প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল হিসেবে এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ঘরে বসে ভাতা পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করার মতোই বলে মনে করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সমাজসেবা অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮-৯৯ অর্থ বছরে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তার বিধান রেখে বয়স্ক ভাতা চালু করা হয়।
একই অর্থ বছরে বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারীদের পরিবার ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য বিধবা ভাতা প্রদান শুরু হয় ২০১২-১৩ অর্থ বছরে পাইলট কর্মসূচির মাধ্যমে বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য ভাতা চালু হয়। ওই অর্থ বছরেই হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য ভাতা চালু হয়। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় “ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি” আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরেই প্রতিটি খাতের যাত্রা শুরু হয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে মাঠ পর্যায়ের দপ্তর গুলো স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের সহযোগিতায় ভাতাভোগী নির্বাচনের কাজ করে থাকে। করোনার কারণে সময়ে প্রান্তিক পর্যায়ের অসহায় মানুষের সহায়তায় বাড়তি নজরে দেয়ার অংশ হিসেবে এই খাতে আগের তুলনায় বেশি অগ্রাধিকার দিয়েছে সরকার। কর্মসূচির আওতায় প্রায় এক কোটি লোককে বিভিন্ন প্রকার ভাতা ও অনুদান প্রদান করা হয়।
২০১৮ সাল থেকে সকল ভাতাভোগীর ডিজিটাল তথ্যভান্ডার তৈরির পাইলটিং কাজ শুরু করা হয়। জিটুপির (গভর্নমেন্ট টু পিপল) এর আওতায় এরই মধ্যে মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সকল ভাতাভোগীর মোবাইলে হিসাব খোলা হয়েছে। ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভাতাভোগীরা ব্যাংকে সিরিয়াল দেয়ার ভোগান্তি ছাড়াই ঘরে বসে প্রতিমাসে তাদের ভাতা পেয়ে যাবেন। রাজবাড়ী জেলা সমাজসেবা অফিস সূত্রে জানা যায়, ৫টি উপজেলায় মোট সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৭৬ হাজার ৯২৬ জন। এর মধ্যে বয়স্ক ভাতাভোগী ৪৩ হাজার ৯৩৮, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারী ভাতাভোগী ১৬ হাজার ৯০০, অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী ১৫ হাজার ৬৬৭ জন এবং প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি ৪২১ জন।
এরই মধ্যে এই বৃহৎ সংখ্যার সুবিধাভোগীদের মোবাইল হিসাব খোলা সহ অনলাইনে তথ্য এন্ট্রির কাজ শেষ হয়েছে। বহু সংখ্যক ভাতাভোগীর সাথে কথা বলে জানা যায়, আগে ভাতার টাকা উঠাতে একটা দিন কামাই হতো। বই জমা দিয়ে সিরিয়াল দিয়ে টাকা নিতে হতো। কোনো কোনো দিন টাকা ছাড়া ফেরত আসতে হয়েছে, পরবর্তী দিনে আবার যেতে হয়েছে। যারা শারীরিক প্রতিবন্ধী এদের জন্য ছিলো চরম দুর্ভোগের।
ব্যাংকে গিয়ে দীর্ঘ লাইনের পাশাপাশি অনেক ব্যাংক দ্বিতীয় তলায় হওয়ায় প্রতিবন্ধী, বয়স্ক ভাতাভোগীদের বিশেষ করে পঙ্গু ও দৃষ্টিহীন ভাতাভোগীদের অনেক ভোগান্তিতে পরতে হতো। এখন আর সেই সমস্যা নেই। এখন ঘরে বসে মোবাইলের মাধ্যমে মিলছে ভাতার টাকা। সদর ইউনিয়নের বয়স্ক ভাতাভোগী মাখন লাল মন্ডলের পুত্র গোপাল চন্দ্র মন্ডল বলেন, ‘আগে অনেক দুর্ভোগ হতো। মনে করেন বাবার ভ্যানে করে নিয়ে গিয়ে বই জমা দিতে হতো, তারপর দীর্ঘসময় অপেক্ষার পর হাতে টাকা পেতাম। এতে হয়তো কোন কোন দিন পেটে ভাতই জোটেনি অপেক্ষায় থাকতে থাকতে। কারণ ওই দিনে সবার উপস্থিতিতে প্রচুর চাপ থাকতো, গরমের মধ্যে দুর্ভোগ চরমে যেতো। পুরো একটা দিন কামাই হতো। এখন আর সেই সমস্যা নেই।
তিনবার মোবাইলে টাকা পেয়েছি। এর জন্য আর ভাবতে হয় না আমাদের। অপর ভাতাভোগী শারীরিক প্রতিবন্ধী মহিন উদ্দিন শেখ বলেন, আগে অনেক কষ্ট হতো। সকালে বই জমা দিয়েছি, দুপুরের পরে গিয়ে হাতে টাকা পেয়েছি। এখন সেই সমস্যা নেই ঘরে বসেই ভাতার টাকা পাচ্ছি। ডিজিটাল পদ্ধতিতে ঘরে বসে টাকা পাওয়ায় তারা প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। বালিয়াকান্দি উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা অজয় হালদার বলেন, অত্র উপজেলায় ৪ ক্যাটাগরিতে ভাতাভোগীর সংখ্যা ১১ হাজার ৫১২ জন। করোনাকালীন লকডাউনের মাঝে বৃহৎ জনগোষ্ঠির মোবাইলে একাউন্ট খোলা নিশ্চিত করানো এবং অনলাইনে তথ্য এন্ট্রির কাজ সম্পন্ন করা এক ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিলো। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই ডিজিটাল তথ্য ভান্ডারে আমরা শতভাগ তথ্য এন্ট্রি করতে সক্ষম হয়েছি। এরই মধ্যে ৩ কিস্তির টাকা মোবাইলে পরিশোধ হয়েছে।
চতুর্থ কিস্তির কাজও সম্পন্ন হয়েছে, দুয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া আর কোন অভিযোগ পাইনি বলেও তিনি জানান। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আম্বিয়া সুলতানা বলেন, অতীতে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ আসতো ভাতাভোগী কর্তৃক। ভাতার টাকা গ্রহণের দিনেও খুব কষ্ট করতে হতো তাঁদের। এখন আর সেই সমস্যা নেই। তাদের দেয়া নম্বরেই টাকা পৌছে যাচ্ছে নির্দিষ্ট সময়ে। এটাই ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল বলেও তিনি মনে করেন। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: আবুল কালাম আজাদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারই দরিদ্র মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে এসব ভাতা চালু করেছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গড়ে তুলেছেন ডিজিটাল বাংলাদেশ।
ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল হিসেবে দৃষ্টান্ত বলা যেতে পারে এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মোবাইলের মাধ্যমে ভাতা বিতরণ। এরই মধ্যে বালিয়াকান্দি উপজেলায় সমাজসেবা দফতরের অধিনস্থ প্রায় ১২ হাজার সুবিধাভোগীরা ঘরে বসে ভাতার টাকা হাতে পেয়েছেন বলেও তিনি জানান। সমাজসেবা অধিদফতরের সামাজিক নিরাপত্তা শাখার পরিচালক মো: সাব্বির ইমাম বলেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ভাতাভোগীদের দুর্ভোগ কেটে গেছে। বয়স্ক, প্রতিবন্ধীরা বাড়ী থেকে ভ্যান রিজার্ভ করে ঘন্টার পর ঘন্টা টাকার অপেক্ষায় থেকেছে, সেই রীতি শেষ হয়ে গেছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল পেতে শুরু করেছে ভাতাভোগীরা। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ লকডাউনের মাঝেই নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে অনলাইনে ভাতাভোগীদের তথ্য ভান্ডার গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। জিটুপির (গভর্নমেন্ট টু পিপল) এর আওতায় এরই মধ্যে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে আমরা ৮৮ লক্ষ ৫০ হাজার সুবিধাভোগীকে সফলভাবে মোবাইলে ভাতা প্রদান করতে পেরেছি। আগামী অর্থ বছরে ১৫০টি উপজেলায় আরও প্রায় ১৫ লক্ষ সুবিধাভোগী তথ্য ভান্ডারে যোগ হবে বলেও তিনি জানান।